ধর্ম

কবর বা আলমে বরজখ কেমন জগত?

কবর বা আলমে বরজখ কেমন জগত?

‘আলম’ শব্দের অর্থ জগত বা পৃথিবী। আর ‘বরজখ’ মানে আড়াল, পর্দা, পার্থক্যকারী, বিচ্ছেদকারী। পবিত্র কোরআনে বরজখ শব্দটি এই অর্থে এসেছে। যেমন- ‘ওই দুইয়ের মাঝে রয়েছে বরজখ, ফলে তারা উভয়ে মিলিত হতে পারে না।’ (সুরা আর-রহমান: ২০) আয়াতটিতে বলা হচ্ছে, দুই পানির (লোনা ও মিষ্টি) মাঝে অন্তরায় রয়েছে, যা ওই দুটিকে আলাদা করে রাখে এবং একটি আরেকটির সঙ্গে মিশতে পারে না। সুতরাং দুটি জিনিসের মধ্যে অন্তরায় সৃষ্টিকারী জিনিসকে বরজখ বলা হয়। আলমে বরজখ হচ্ছে দুই জীবন—অর্থাৎ দুনিয়া ও আখেরাতের মাঝে ব্যবধান সৃষ্টিকারী।

বরজখের সময় হচ্ছে মৃত্যু থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত। চাই মৃতদেহ কবরে দেওয়া হোক বা না হোক, কিংবা শূলীতে চড়ানো হোক, অথবা সমুদ্রে ডুবে যাক কিংবা ছিন্নভিন্ন বা ভস্ম হয়ে উড়ে যাক, সকলের স্থানই বরজখে। (শারহুস সুদুর: পৃষ্ঠা-১৬৪)

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এরপর যখন তাদের কারো মৃত্যু আসবে, তখন সে বলবে, হে আমার রব, আমাকে আবার ফেরত পাঠান। যাতে আমি সৎ কাজ করতে পারি যা আমি করিনি। কক্ষনো না, এটা তো তার একটা কথার কথা মাত্র। তাদের সামনে বরজখ থাকবে পুনরুত্থানের দিন পর্যন্ত।’ (সুরা মুমিনুন: ৯৯-১০০)

ব্যাকরণবিদ ইমাম ফাররা বলেছেন, মরণের দিন হতে পুনরুত্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত হলো বরজখ। (লিসানুল আরব: খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৯০৮)

একবার ইমাম শাবীকে বলা হলো, অমুক মারা গেছে। তিনি বললেন, সে এখন দুনিয়াতেও নেই, আখেরাতেও নেই। সে এখন বরজখের জগতে আছে। (তাসকিরাহ: পৃষ্ঠা-১৫৮)

মৃত্যুর পরে রুহ কোথায় যায়?
হজরত বারা বিন আজিব (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, মুমিন বান্দার যখন মরণক্ষণ ঘনীভূত হয়ে যায়, ফেরেশতা তার নিকট উত্তম আকৃতিতে সুগন্ধিতে সুরভিত হয়ে আগমন করে। মুমিনের রুহ কবজ করার জন্য তার পাশে বসে। আর দু’জন ফেরেশতা জান্নাত হতে সুগন্ধিপাত্র নিয়ে তার কাছে উপস্থিত হন। তারপর ফেরেশতাদ্বয় রুহ নিয়ে জান্নাতের দিকে গমন করেন। তাদের জন্য আরশের দরজা খুলে দেওয়া হয়। তাদের জন্য আকাশের দরজাও খুলে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন: কবরে যাদেরকে প্রশ্ন করা হবে না

আকাশের ফেরেশতারা তার আগমনে আনন্দিত হন আর বলেন, এ পবিত্র রুহটি কার, যার আগমনে আকাশের প্রবেশদ্বারসমূহ খুলে দেওয়া হয়েছে তখন তার সুন্দরতম নাম উল্লেখ করা হবে, যে নামে তাকে পৃথিবীতে নামকরণ করা হতো। অনন্তর বলা হবে, এটা অমুক ব্যক্তির রুহ। তারপর ওই রুহকে নিয়ে যখন ঊর্ধ্বে আরোহণ করতে থাকেন, তখন আল্লাহপাক বলেন, আমার বান্দার আত্মাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নাও। কেননা, আমি তাদের মর্তে ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছি। যখন মুমিনকে পুনরায় কবরে ফেরত দেওয়া হয়, তখন কবরের মাটি তাকে বলে, তুমি আমার পৃষ্ঠে থাকতে আমার নিকট প্রিয় ছিলে।

সুতরাং কেমন হবে যখন তুমি আমার অভ্যন্তরে এসেছ। তুমি দেখতে পাবে আমি তোমার সাথে কেমন আচরণ করি। তারপর তার দৃষ্টির সীমা পর্যন্ত কবর প্রশস্ত হয়ে জান্নাতের দিকে একটি দরজা খোলা হবে। তাকে বলা হবে তুমি লক্ষ করো, আল্লাহ তাআলা তোমার জন্য কী পারিতোষিক তৈরি করে রেখেছেন। আর মাথার দিক থেকে দোজখের দিকে একটি দরজা খোলা হবে, আর বলা হবে তুমি দেখ, আল্লাহ তাআলা তোমার থেকে কেমন শাস্তি ও আজাব দূর করে দিয়েছেন। অতঃপর তাকে বলা হবে, পরিতৃপ্তি ও শান্তির সাথে অবস্থান করো। তখন তার নিকট কেয়ামত অনুষ্ঠিত হওয়াই সবচেয়ে প্রিয় বিষয় হবে। (মেশকাতুল মাসাবিহ: খণ্ড ১, পৃষ্ঠা-১৪২)

কার রুহ কোথায় রাখা হয়?
আমরা হাদিস থেকে জানি, একজন মৃত মানুষের রুহকে যখন বের করে নেওয়া হয়; যদি সে দ্বীনদার হয়, তাহলে আল্লাহ তাআলা বলেন- তার রুহকে ইল্লিয়িন এর মধ্যে রাখো। ইল্লিয়িন হচ্ছে- সর্ব উপরের ও সম্মানের একটি স্থানের নাম। আর যদি দ্বীনদার না হয়, বিশ্বাসী না হয়; তখন সিফফিন নামে একটি স্থান আছে— একটি অধস্থন ও নিকৃষ্ট স্থান, সেখানে ওই রুহ রাখা হয়।

শরীর নিশ্চিহ্ন হলে সওয়াল জবাব কীভাবে হবে?
আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের সদস্যগণ বলেন, মৃত্যুর সময় দেহ হতে রুহ বের করা হয়। রুহ ধ্বংস হয় না। এর উপযুক্ত ঠিকানা ও স্থিতিস্থানের প্রয়োজন হয়। সব দেহকে কবরস্থ করার পর সওয়াল-জওয়ারের জন্য উক্ত দেহে রুহ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর দেহের সাথে রুহের এতটুকু সম্পর্ক অবশ্যই স্থায়ী হয়, যার দ্বারা শান্তি ও শাস্তি অনুভব করতে পারে। (শারহু ফিকহে আকবর: পৃষ্ঠা-১০১)

আরও পড়ুন: জান্নাতি মানুষের ১১ গুণ

ফেরেশতাদের সওয়াল-জবাব
হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, তার কাছে দুজন ফেরেশতা এসে তাকে বসিয়ে প্রশ্ন করে, তোমার রব কে? তখন সে বলে, আমার রব আল্লাহ। তারা উভয়ে তাকে প্রশ্ন করে, তোমার দ্বীন কী? সে বলে, আমার দ্বীন ইসলাম। তারা প্রশ্ন করে, এ লোকটি তোমাদের মধ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন, তিনি কে? সে বলে, তিনি আল্লাহর রাসুল (স.)। তারপর তারা আবার জিজ্ঞেস করে, তুমি কী করে জানতে পারলে? সে বলে, আমি আল্লাহর কিতাব পড়েছি এবং তার প্রতি ঈমান এনেছি এবং সত্য বলে স্বীকার করেছি। অতঃপর আকাশ থেকে ঘোষণা আসে, আমার বান্দা যথাযথ বলেছে। সুতরাং তার জন্য জান্নাতের একটি বিছানা বিছিয়ে দাও এবং তাকে জান্নাতের পোশাক পরিয়ে দাও। এছাড়া তার জন্য জান্নাতের দিকে একটা দরজা খুলে দাও। তিনি (স.) বলেন, সুতরাং তার দিকে জান্নাতের স্নিগ্ধকর হাওয়া ও তার সুগন্ধি বইতে থাকে। তিনি আরো বলেন, ওই দরজা তার দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত প্রশস্ত করা হয়।

অতঃপর নবী (স.) কাফিরদের মৃত্যু প্রসঙ্গে বলেন, তার রুহকে তার শরীরে ফিরিয়ে আনা হয় (অথবা রুহের সাথে তার শরীরকে যোগ করা হয়) এবং দুজন ফেরেশতা এসে তাকে বসিয়ে প্রশ্ন করে, তোমার রব কে? সে উত্তর দেয়, হায়! আমি কিছুই জানি না। তারপর তারা প্রশ্ন করেন, তোমার দ্বীন কী? সে বলে, হায়! আমি কিছুই জানি না। অতঃপর তারা প্রশ্ন করে, এ লোকটি তোমাদের মধ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন তিনি কে? সে বলে, হায়! আমি তো জানি না। তখন আকাশ থেকে ঘোষণা আসে, সে মিথ্যা বলেছে। সুতরাং তার জন্য জাহান্নামের একটি বিছানা বিছিয়ে দাও এবং তাকে জাহান্নামের পোশাক পরিয়ে দাও, আর তার জন্য জাহান্নামের দিকে একটা দরজা খুলে দাও।

তিনি (স.) বলেন, অতঃপর তার দিকে জাহান্নামের উত্তপ্ত বাতাস আসতে থাকে। এছাড়া তার জন্য তার কবরকে সংকীর্ণ করে দেওয়া হয়, ফলে তার এক দিকের পাঁজর অপর দিকের পাঁজরের মধ্যে ঢুকে যায়। জারির বর্ণিত হাদিসে আছে, অতঃপর তার জন্য এক অন্ধ ও বধির ফেরেশতাকে নিযুক্ত করা হয়, যার সঙ্গে একটি লোহার হাতুড়ি থাকবে, যদি এ দ্বারা পাহাড়কে আঘাত করা হয় তাহলে তা ধুলায় পরিণত হয়ে যাবে।

নবী (স.) বলেন, তারপর সে তাকে হাতুড়ি দিয়ে সজোরে আঘাত করতে থাকে, এতে সে বিকট শব্দে চিৎকার করতে থাকে, যা মানুষ ও জিন ছাড়া পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সব সৃষ্টি জীবই শুনতে পায়। আঘাতের ফলে সে মাটিতে মিশে যায়। তিনি বলেন, অতঃপর (শাস্তি অব্যাহত রাখার জন্য) পুনরায় তাতে রুহ ফেরত দেওয়া হয়। (আবু দাউদ: ৪৭৫৩)